পিরিয়ডের সময় পরিচ্ছন্নতা কেন জরুরি?

পিরিয়ডের সময় পরিচ্ছন্নতা কেন জরুরি?

রচনা রায় বড় কর্পোরেট সংস্থায় কর্মরত। শিক্ষিত এবং সচেতন। তা সত্ত্বেও কিশোরী বয়স থেকেই তাঁর পিরিয়ড নিয়ে বড় সংকোচ। এই বিশেষ সময়ের যত্ন নিয়ে কারও সঙ্গে খোলখুলি আলোচনা তো দূর, নিজে দোকানে গিয়ে কখনও স‌্যানিটারি ন‌্যাপকিনের একটা প‌্যাকেটও কেনেননি। প্রথম থেকেই তার মা প‌্যাড এনে দিয়েছে। বিয়ের পরও বহুদিন পর্যন্ত মায়ের উপরেই ভরসা রেখেছে। স্বামীর কাছেও পিরিয়ড নিয়ে মন খুলে কথা বলতে পারেনি, কোনও সমস‌্যা হলেও। তারপর মেয়ে জয়ার বেলাতেও একই ঘটনা ঘটেছে। জড়তা ও সংকোচের কারণে মায়ের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে পারে না জয়া। তবে, তাকেও মা-ই দোকান থেকে প‌্যাড এনে দেয়। মেয়ের মুখ চেয়ে শেষে ওটুকু দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটাতে পেরেছেন রচনা।

শহরের শিক্ষিত ও চাকরিজীবী মহিলাদেরই যখন এই সংকোচ, তখন অন্যদের কথা তো সহজেই অনুমান করা যায়। এটা অত‌্যন্ত বাস্তব যে মাসিক বা পিরিয়ডের দিনগুলিতে স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সুরক্ষা ও সাবধানতা সম্পর্কে আমাদের দেশের মহিলারা মোটেই খুব বেশি সচেতন নন। পরিবারের বড়দের সঙ্গে তো বটেই, সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গেও এই নিয়ে আলোচনার সংকোচ ও লজ্জা কাটিয়ে উঠতে না পারা এর একটা অন‌্যতম প্রধান কারণ। অথচ প্রতিটি মহিলার ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটি নিয়ে সংকোচ, জড়তা বা লজ্জার কিছু নেই। একজন নারীর নিয়মিত ও সঠিক ঋতুস্রাব হওয়ার অর্থ, তিনি সন্তান ধারণে সক্ষম। অবশ‌্য, আমাদের সমাজেরও এটি নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি এখনও স্বাভাবিক নয়। ঋতুস্রাব চলাকালীন অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য আমাদের দেশের অধিকাংশ মহিলাই প্রস্রাবের সংক্রমণ ও জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হন। সংখ‌্যাটি নগন‌্য নয়।

নারীস্বাস্থ্য, বিশেষ করে নারীর প্রজননস্বাস্থ্য এবং মাসিকের সময় পরিচ্ছন্নতা বা নিরাপদ ব‌্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় অত‌্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি যদি সমাজের প্রচলিত ট্যাবু হয়ে থাকে, তবে অন্যটি হল স্যানিটারি প্যাডের দাম। আমাদের দেশে ১০টি স্যানিটারি প্যাডের একটি প্যাকেট দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। স্বাস্থ‌্য সচেতনতার অভাবে এবং প‌্যাডের দাম ধয়াছোঁয়ার বাইরে থাকার কারণে আমাদের দেশে, বিশেষ করে দরিদ্র ও গ্রামাঞ্চলের পরিবারের মহিলাদের অর্ধেকের বেশি ডিসপোজিবল প্যাড ব‌্যবহার করতে পারে না। তারা পুরোনো কাপড়ে ঘরোয়া ভাবে কাজ চালায়। কিছু অংশের মহিলা অবশ‌্য সস্তায় পাওয়া নতুন কাপড় ও তুলো ব‌্যবহার করেন।

তবে নারীস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং শারীরিক জটিলতা এড়াতে পিরিয়ডের সময় কিছু সচেতনতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা জরুরি।

১) পিরিয়ডের সময় স্যানিটারি প্যাড বা মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করুন। কাপড়, তুলা বা টিস্যু ব্যবহার এড়িয়ে চলুন।

২) চার থেকে ছয় ঘণ্টা পরপর স্যানিটারি প্যাড পরিবর্তন করা দরকার। ৩) যোনির আশপাশে র‍্যাশ এড়াতে যথাসময়ে প্যাড পরিবর্তন এবং যোনিপথের আশপাশ শুকনো রাখা প্রয়োজন।

৪) ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন এড়াতে প্রতিদিন স্নান করতে হবে। পরিষ্কার অন্তর্বাস ব্যবহার জরুরি।

৫) ব্যবহৃত অন্তর্বাস পরিষ্কার করে ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিন।

৬) যোনিপথের আশপাশে সুগন্ধী বা অ্যালকোহলযুক্ত কিছু ব্যবহার উচিত নয়।

৭) পিরিয়ডের সময় জরায়ুতে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা জরুরি।

৮) ভারী কাজ, ব্যায়াম, সাঁতার বা সাইকেল চালানো থেকে বন্ধ রাখুন এই ক’টা দিন।

৯) হরমোনের প্রভাবে এ সময় কারও কারও মানসিক ও শারীরিক বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে থাকে। তাই মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করুন।

১০) এই সময় বাইরের খাবার এড়িয়ে পুষ্টিকর খাবার খান। প্রচুর জল পান করুন।

অনিয়মিত পিরিয়ড

যে কোনও বয়সে নারীর ঋতুস্রাব অনিয়মিত হতে পারে। ২৮ দিনের জায়গায় ২১ থেকে ৩৫ দিন পরপর হলেও তা যদি নিয়মিত ব্যবধানে হয়, তাকে স্বাভাবিক হিসেবেই ধরা হয়ে থাকে। তবে ২১ দিনের আগে বা ৩৫ দিনের পর হলে এবং যদি তা তিন দিনের কম বা সাতদিনের বেশি স্থায়ী হয়, তখন তাকে অনিয়মিত ঋতুচক্র বলে।

অনিয়মিত পিরিয়ডের কারণগুলি হলো– ১) পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (পিসিওএস), ২) শরীরের ওজন হঠাৎ বেড়ে যাওয়া, ৩) হঠাৎ ওজন কমিয়ে ফেলা, ৪) অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ৫) জরায়ুর টিউমার, ৬) থাইরয়েডের সমস্যা, ৭) জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহার, ৮) যে মায়েরা সন্তানকে বুকের দুধ দেন, ৯) মাত্রাতিরিক্ত শরীরচর্চা, ১০) কৈশোরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের তারতম্য।

প্রতিকার

অনিয়মিত পিরিয়ড হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সব সময় স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও শরীরচর্চার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। খেতে হবে পুষ্টিকর খাবার। মানসিক চাপমুক্ত থাকা জরুরি। রোগের কারণ নির্ণয় করার পর সঠিক চিকিৎসার মধ্যে থাকলেই আবার নিয়মিত মাসিক শুরু হবে।

(কেবলমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধির জন‌্য ধারণা দেওয়ার হেতু। সব সমস্য‌ায় চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করুন)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন