পিরিয়ড, মাসিক বা ঋতুস্রাব প্রতিটি সুস্থ নারীর জীবনে একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। তবে এই স্বাভাবিক বিষয়টিকেই আমাদের সমাজে আড়াল করে রাখার কারণে, বিষয়টিতে কিশোর বয়স থেকেই মেয়েদের বিভিন্ন ভুল ধারণার সৃষ্টি তো হয়ই, তাছাড়া সচেতনতার অভাব থাকার কারণে অনেক শারীরিক জটিলতার সৃষ্টি হয়। তবে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, একজন মেয়ের প্রথমবার মাসিক হওয়ার পর তার কাউন্সেলিং-এর পাশাপাশি অন্তত ছয় মাস তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার অভিভাবকদের। তবে জীবনের শুরুতে পিরিয়ড সম্পর্কে শঙ্কা বা পিরিয়ড সংক্রান্ত সমস্যা কাটিয়ে উঠে এর সঙ্গে মানসিকভাবে মানিয়ে নেওয়া মেয়েটির পক্ষে সহজ হবে।
সাধারণভাবে, পিরিয়ডের শুরুটা অনেক মেয়ের কাছেই ভয়ের হয়। ওই সময় কোনও শারীরিক বা মানসিক জটিলতা দেখা দিলে, তার রেশ অনেকদিন পর্যন্ত থেকে যায়। এক গৃহবধূ বলছিলেন, “আমাদের কিশোরবেলায় পিরিয়ডের বিষয়ে কথা বলার বা কারও পরামর্শ নেওয়ার কোনও সুযোগ পাইনি। কারণ পিরিয়ডের বিষয়ে ঘরে বাইরে কথা বলাটা কিছুদিন আগেও বেশ কঠিন ছিলো। মা যেটুকু বুঝিয়েছিলেন তাঁর মতো করে তাই জানতাম। তা-ও অনেক রাখঢাক করে। সেখানে হাইজিনের ধারণাটাই তো ছিল না। নিজেও কষ্ট পেয়েছি, আবার বন্ধুদের কয়েকজনকে দেখেছি প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করতে। কিন্তু কেউ তাতে গুরুত্ব দিত না।” এক চাকরিরতা মহিলার কথায়, “মা-দিদিমারা সাবধান করতেন পিরিয়ডের ব্যাপার-স্যাপার যেন অত্যন্ত গোপন রাখি। এমনকি, বাবা-ভাই বা বাড়ির পুরুষরা যাতে জানতে না পারে। এর কারণ খুঁজে পাইনি, প্রশ্ন করেও উত্তর পাইনি। আমার আশ্চর্য লাগতো, জ্বর হলে বাবা-ভাই মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করতো কী কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু, ওই দিনগুলোতে শরীরে কষ্ট হলে তারা কেউ কাছেই আসতে চাইতো না। ধরেই নিতে যেন, অমন হয়েই থাকে।”
চিকিৎসকদের পরামর্শ, প্রথমত কাউন্সেলিং, দ্বিতীয়ত পর্যাপ্ত পরিমাণ সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং তৃতীয়ত বিশ্রাম। প্রথম পিরিয়ডে এগুলি নিশ্চিত করতে হবে। বেশি রক্তক্ষরণ হলে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে। ঠিক সময়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে পরে অন্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই এ সময় পুষ্টিকর খাবার, বিশেষ করে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খেতে হবে। তিনি বলেন, পিরিয়ডের সময় মেয়েদের শরীর থেকে ভিটামিন ও খনিজ বের হয়ে যায়। এজন্য চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের সঙ্গে কথা বলে সুষম খাদ্যের তালিকা করে তাকে খাওয়াতে হবে।
তবে এই সবের সঙ্গেই আরও জরুরি হল, পিরিয়ডের শুরুর দিকে মায়েদের উচিত তার সদ্য কৈশরে পা দেওয়া মেয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা। সম্ভব হলে কাউন্সেলিং শুরু করা। অন্তত এক থেকে দু’বছর পর্যন্ত ক্যালেন্ডার অর্থাৎ মাসিকের সময়কাল পর্যবেক্ষণ করে তা নোট করে রাখার দরকার। এই সময় মেয়েদের শরীরে হরমোনাল পরিবর্তন আসে। কারও পিরিয়ড নিয়মিত হলেও অনেকের দেরি করে হয় কিংবা ব্লিডিং বেশি হয় যা অনেককে রক্তশূন্যতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। অন্য কোনও সমস্যা না হলে উদ্বিগ্ন না হয়ে তার পরিচর্যা করতে হবে। তবে অতিমাত্রায় ব্লিডিং হতেই থাকলে চিকিৎসকের কাছে যেতেই হবে। শুধু বেশি ব্লিডিং নয়, বেশি ব্যথা হলেও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করা দরকার হতে পারে এবং সময়মত এটি করলে পরে অনেক জটিলতার আশঙ্কা থাকে না।
মাসিককে কেন্দ্র করে মেয়েদের পরিচর্যার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে:
১. পুষ্টিকর খাবার বিশেষ করে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম
৩. হাইজিন সম্পর্কে ধারণা
৪. পর্যাপ্ত প্রোটিন ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাদ্যগ্রহণ
স্বাস্থ্যসম্মত মাসিক: ইউনিসেফের পরামর্শ
কিশোরীদের মাসিক চলাকালীন করণীয় সম্পর্কে ইউনিসেফের প্রচারপত্রে বলা হয়েছে ভবিষ্যতের মানবসম্পদ হিসেবে কিশোরীদের মাসিক তথা প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে পিরিয়ডের সময় করণীয় সম্পর্কে যেসব পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো:
১. প্রয়োজনে মা-বাবা ও পরিবারের অন্য মহিলা সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা।
২. স্যানিটারি ন্যাপকিন বা পরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করা এবং অভিজ্ঞদের কাছে এর ব্যবহার বিধি জেনে নেওয়া।
৩. মাসিকের সময় ব্যবহৃত পোশাক অপরিস্কার জলে না ধোওয়া, বরং সাবান ও পরিষ্কার জল দিয়ে ভালো করে ধোওয়া।
৭. মাসিকের কাপড় অন্ধকার ও স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় শুকাতে না দিয়ে, পরিষ্কার জায়গায় রোদে শুকানো ও নিরাপদ জায়গায় সংরক্ষণ।
৮. পুষ্টিকর খাবার বিশেষ করে দুধ, মাছ, মাংস, ডিম, শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে। অন্য সময়ের তুলনায় বেশি খাবার খেতে হবে।
৯. তলপেটের ব্যথার সময় বোতলে গরম জল নিয়ে সেঁক দিলে আরাম পাওয়া যাবে।
১০. অতিরিক্ত ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
১১. বিশ্রামে থাকতে হবে, তবে স্কুলে যাওয়া বা ঘরের কাজ করার মতো স্বাভাবিক কাজ করা অব্যাহত রাখা যাবে।
১২. পিরিয়ডের সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কিছু ব্যায়াম শরীর ও মনকে ভালো রাখতে পারে।
(কেবলমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ধারণা দেওয়ার হেতু। সব সমস্যায় চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করুন)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন