পিরিয়ড নিয়ে নানা মিথ ও বিজ্ঞান

পিরিয়ড নিয়ে নানা মিথ ও বিজ্ঞান

২০২৪-এ দাঁড়িয়েও পিরিয়ড নিয়ে প্রচলিত বহু মিথ ও পিরিয়ড চলাকালীন মেয়েদের উপর চলা অকথ্য মানসিক নির্যাতন, মানব সভ্যতার অগ্রগতি নিয়েই প্রশ্ন তোলে। পিরিয়ড বা মাসিক বা ঋতুস্রাব একটি স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক জৈবিক প্রক্রিয়া। অথচ ভারতে, তথাকথিত শিক্ষিত, সচেতন ও উদার সমাজেও মাসিক নিয়ে কথা বলা, আলোচনা এখনও এরপ্রকার নিষিদ্ধ। মাসিক নিয়ে কদর্য উপহাস হয়, কটাক্ষ হয়। আজও মাসিকের সময় একজন মহিলা ও কিশোরীর ঠাকুরঘরে ঢোকা বারণ, রান্নাঘরে ঢোকা বারন, চুল খোলা রাখার নিষেধ। এখনও শহরের ওষুধের দোকানেও স‌্যানিটারি ন‌্যাপকিন একটি নিষিদ্ধ বস্তুর মতো কাগজে মুড়ে গোপনে দেওয়া হয়। অতি সামান‌্য কথায় বেচা-কেনা হয়ে যায়, যেখানে ক্রেতার পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশের সুযোগ থাকে না। কোনও মহিলা দোকানে সরাসরি স‌্যানিটারি ন‌্যাপকিন চাইলে পাশের পুরুষ ক্রেতাটির ভ্রু ইষৎ কুঞ্চিত হয়। এ ছবি শুধু ভারতের নয়, এশিয়া, আফ্রিকা, এমনকি ইউরোপের দেশগুলিতে আজও বহু মেয়ে পিরিয়ড নিয়ে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের শিকার। আরও আশ্চর্যের যে এই প্রচলিত কুপ্রথাগুলি দীর্ঘদিন ধরে নারীরা নিজেরাই বয়ে চলেছেন। অবশ‌্য আশার কথা, বর্তমানে পিরিয়ড সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচার ও শিক্ষা বিষয়টিকে ক্রমশ স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনছে।এখানে মাসিক নিয়ে কিছু মিথ ও বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করা হল।

মিথ : পিরিয়ডের সময় নির্গত রক্ত অপবিত্র!
বিজ্ঞান : পিরিয়ড সাইকেল বা মাসিক চক্র নারীর প্রজনন প্রক্রিয়ার একটি অংশ। পিরিয়ডের সময় অনিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর নরম পুরু আবরণ ভেদ করে রক্ত ও নষ্ট হয়ে যাওয়া টিস্যুর সঙ্গে যোনিপথ দিয়ে নির্গত হয়। এই রক্তের রঙ গাঢ় লাল থেকে বাদামী রঙের হয়। সুতরাং কোনও ভাবেই পিরিয়ডের রক্ত অপবিত্র নয়। বরং পিরিয়ড একজন নারীর শরীরকে গর্ভাবস্থার জন্য প্রস্তুত করে।

মিথ : পিরিয়ড মিস হওয়া মানেই গর্ভবতী হয়ে পড়া!
বিজ্ঞান : ডিম্বাণু নিষিক্ত না হলে কোনও নারী অন্তঃসত্ত্বা হতে পারেন না। মাসিক বিলম্বে হওয়া অথবা মিস যাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, অতিরিক্ত ওজন, অস্বাস্থ‌্যকর খাদ্যাভ্যাস, Polycystic Ovarian Disease বা Polycystic Ovary Syndrome-এর মতো ওভারিতে সিস্টের সমস্যা, এমনকি মানসিক চাপের কারণেও কোনও কোনও সময় মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। তবে পরপর বেশ কয়েকমাস মাসিক অনিয়মিত হতে থাকলে ডাক্তার দেখানো উচিত।

মিথ : পিরিয়ডের সময় যৌনমিলন নিরাপদ, গর্ভধারণের সম্ভাবনা নেই!
বিজ্ঞান :
সাধারণত, পিরিয়ড চলাকালীন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার সম্ভবনা থাকে না, কিন্তু তা একেবারে অসম্ভবও নয়। পিরিয়ডের সময় অনেকেই ধরে নেয় যে ডিম্বাণু নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু চিকিৎসকরা বলেন, এই সময়ও ডিম্বাণু সক্রিয় থাকতে পারে। তাই পিরিয়ড চলাকালীন অসুরক্ষিত যৌনমিলনে খুব সামান্য হলেও ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকেই। এছাড়াও কিছুক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর আস্তরণের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সময় সামান্য রক্ত নিঃসৃত হয়। অনেকেই এটিকে মাসিক ভেবে ভুল করেন। আসলে এটিকে এমপ্লান্টেশন ব্লিডিং বলে।

মিথ : পিরিয়ড চলাকালীন চুল ধোওয়া উচিত নয়!

বিজ্ঞান : এই ধারণা একেবারেই অ-বৈজ্ঞানিক। পিরিয়ডের সময় সাধারণ জীবন-যাপন ও ব্যাক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির সঙ্গে আপসের কোনও প্রয়োজনই নেই। তাই চুল ধোওয়ার সঙ্গে পিরিয়ডের কোনও সম্পর্ক নেই। বরং পিরিয়ডের সময় শরীরে হাইজিন বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

মিথ : ন্যাপকিনের বদলে ট্যাম্পন ব্যবহার করলে ভার্জিনিটি নষ্ট হয়!
বিজ্ঞান :
আজকের যুগে কুমারিত্ব বা ভার্জিনিটির ধারণাটাই মিথ। যদিও আজও অধিকাংশ মানুষের ধারণা যোনিপথে কোনও কিছুর প্রবেশ ঘটালেই ভার্জিনিটি নষ্ট হয় অর্থাৎ হাইমেনের পর্দা ভেঙে যায়। কিন্তু সাইকেল চালানো, জিম করা বা আরও বিভিন্ন প্রকারের কঠোর শারীরিক শ্রমের কাজ-কর্মে কোনও মেয়ের হাইমেনের পর্দা ভেঙে যেতে পারে। তবে বর্তমানে বিজ্ঞান বলছে হাইমেন ভিন্ন মহিলার ভিন্ন হয়ে থাকতে পারে। কারও হাইমেন পুরু, কারও আবার খুব পাতলা, আবার কারও প্রাকৃতিকভাবেই হাইমেন নেই।
সে কারণে ভ্রান্ত ধারণাগুলিকে বিদায় জানান। নিজে বিশ্বাস করুন, অন‌্যদের সচেতন করুন। পিরিয়ডের সময় মেয়েদের শরীর দুর্বল থাকে। তাই শরীরের অতিরিক্ত যত্ন প্রয়োজন। জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ বজায় থাকুক, মন ভরে টক খান, স্নান করুন, পুজো দিন ভক্তি নিয়ে। মনে রাখবেন শুধুমাত্র কিছু লোকের কথায় নিজের জীবনের সঙ্গে আপোষ করবেন না।

(কেবলমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধির জন‌্য ধারণা দেওয়ার হেতু। সব সমস্য‌ায় চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করুন)

Post a Comment

أحدث أقدم