পিরিয়ড: সচেতনতার জন্য একটি আলোচনা

পিরিয়ড: সচেতনতার জন্য একটি আলোচনা

কয়েক আগে টরন্টোর বাসিন্দা, সুপরিচিত কপি রূপী কউর তাঁর একটি ইন্সটাগ্রাম পোস্টে চরম সমালোচনার মুখে পড়েন। প্রশ্নবিদ্ধ হন। কিন্তু বিতর্ক আরও তীব্র হয় ইস্টাগ্রাম কর্তৃপক্ষ সেই পোস্টটি মুছে ফেলায়। পোশাকে ও বিছানার চাদরে পিরিয়ডের রক্তের ছাপ থাকা একটি ছবি সেই সময় আমাদের সমাজের মুখোশ খুলে দিয়েছিল। আসলে, রূপী একজন সম্পূর্ণ পোশাক পরিহিত মহিলাকে মাসিকের সময় চিত্রিত করার জন্য ছবিটি পোস্ট করেছিলেন। সেই পোস্ট মুছে দেওয়ার পর রুপী ইনস্টাগ্রাম কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি লিখে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সেই চিঠি অন‌্য একটি সোশ‌্যাল মিডিয়া প্ল‌্যাটফর্মে পোস্ট করে তিনি লিখেছিলেন, –

“তাদের পিতৃতন্ত্র ফুটে উঠছে। তাদের দৈন্যতা ফুটে উঠছে। আমাদের সেন্সর করা হবে না।”


এর বছরখানেক আগে কলকাতার একটি সরকারি বিশ্ববিদ‌্যালয়ের পড়ুয়ারা ধর্ষণ আর যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্যানিটারি প্যাডে প্রতিবাদ লিখে গাছে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। সেটার বিষয়েও দেখা গিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

রূপী নারী জীবনের সেই দিকটিকে তুলে ধরেন, যেখানে সমাজের একটি বড় অংশ বিশ্বাস করে যে পিরিয়ডের সময় নারীকে ঘরবন্দী করে রাখা উচিত, যাতে তা নিয়ে কোনও গুঞ্জন না হয়। তিনি তাঁর পোস্ট নিয়ে নেটিজেনদের প্রশ্ন ও সমালোচনারও জবাব দিয়েছিলেন এইভাবেই। তিনি বলেছিলেন, সমাজ যত তাড়াতাড়ি নারীদেহকে একটি মানবদেহ হিসাবে গ্রহণ করব, যা শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পরিতৃপ্তির জন্য তৈরি করা হয়নি, তত তাড়াতাড়ি আমরা পিরিয়ডকে নোংরা, সামান্য গোপনীয়তার মতো বাবা বন্ধ করতে পারবো। সেন্সরশিপ ছাড়াই নারী জীবনকে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারবেন সব নারী।

নারীর বয়:সন্ধিকালের অন্যতম একটি শারিরীক বৈশিষ্ট্য পিরিয়ড বা মাসিক। প্রতিটি মেয়ের জন্যই এটি একটি সাধারণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। নারীদেহকে সুস্থ ও সন্তানধারণে সক্ষম করতে এই প্রক্রিয়া অতীব প্রয়োজনীয়। কিন্তু স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়াকে সমাজ দেখে ট্যাবু হিসেবে। অনেক পরিবারই এই বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলতে এখন প্রস্তুত নয়।

সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্খেইমের যুক্তি ছিল, মানব ইতিহাসে ধর্মের উৎপত্তিই নাকি ঋতুস্রাবকে কেন্দ্র করে। প্রতিটি ধর্মেই ঋতুস্রাবে কী করণীয় বা অকরণীয়, তা নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে।

বিশ্বের প্রায় প্রতিটি সমাজেই মাসিক বা ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড নিয়ে অনেকগুলি ভুল ধারণা রয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মাসিক হলে চুলে শ‌্যাম্পু করা যাবে না, পুকুরে সাঁতার কাটা যাবে না, কোথাও কোথাও গাছে জল দিতে দেওয়া হয় না, রান্নাঘরে ঢুকতে দেওয়া হয় না কিংবা আলাদা বিছানায় শুতে দেওয়া হয়। ভারত ও বাংলাদেশেও অঞ্চলভেদে ঋতুস্রাব নিয়ে বিভিন্ন ধরণের ট্যাবু রয়েছে। টক খেতে বারন করা হয়, কোথাও কোথাও দুধ কিংবা কলা খেতে দেওয়া হয় না। পুরুষ মানুষের আশপাশে যেতে দেওয়া হয় না। মোট কথা মাসিককে আলোচনা-শোনার অযোগ‌্য হিসাবে দেখা হয়। ফলে মেয়েরা কিশোরী বয়স থেকেই ওই স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়াকে ‘ভয়ের বিষয়’ হিসেবে দেখে। বাড়ির লোক তাদের প্রথম কয়েকদিন স্কুলে বা বাইরে যেতে দেয় না।

ভারত ও বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড ডিস্পেন্সারের ব্যবস্থা নেই। জল কিংবা সাবানের ব্যবস্থাও খুবই নগন‌্য। সে কারণে এই দুই দেশে জরায়ুমুখ ক্যান্সার আর যৌনাঙ্গের নানা সংক্রমণ সমস্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। তাছাড়া, গ্রামে অনেক মহিলা এখনও পিরিয়ডের স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা সম্পর্কে জানে না। তুলা কিংবা পুরানো কাপড় ব্যবহারে তারা স্বচ্ছন্দ।

আধুনিক সমাজে নারী ও পুরুষ অনেক ক্ষেত্রেই কুসংস্কারমুক্ত হতে পারলেও পিরিয়ডের বিষয় নিয়ে কথা বলতে এখনও তাদের মধ্যে সংকোচ রয়েছে। দোকানে ঋতুকালীন ব্যবহার্য পণ্য, বিশেষ করে স্যানিটারি প্যাড বিক্রি করা হয় কালো প‌্যাকেটে বা খবরের কাগজে মুড়ে। যেন এটা নিষিদ্ধ কোনও দ্রব্য কেনা হচ্ছে।

পিরিয়ডের প্রতি ছেলেদের অজানা কৌতুহল ও যথাযথ শিক্ষা না থাকায় জীবনের কোনও পর্যায়ে মা, স্ত্রী কিংবা কন্যার বিশেষ প্রয়োজনকে তারা বুঝতে পারে না। অনেক পুরুষ এ নিয়ে নারীকে দোষারোপও করে থাকেন। বস্তুত, এ সব দেশে যৌন শিক্ষার কোনও ব্যবস্থা না থাকায় ছেলে-মেয়ে উভয়ই উভয়ের কাছে বিশাল রহস্যের আধার।

সমাজ, প্রতিটি নারী-পুরুষ তখনই সচেতন হবে, যখন ট্যাবু ভেঙে এটা নিয়ে নারী-পুরুষ সবাই কথা বলবে। সেইসঙ্গে ঋতুকালে ব্যবহৃত পণ্যের দাম কমানোর জন্য সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। ২০১৬ সালেআমেরিকায় পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব নিয়ে একটি ক্যাম্পেইন শুরু হয়। সেখানে বেশ কয়েকটি প্রদেশে ঋতুস্রাবে ব্যবহৃত পণ্যের উপর ভ্যাট তুলে দেওয়ার আইনও পাস হয়।

(কেবলমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধির জন‌্য ধারণা দেওয়ার হেতু। সব সমস্য‌ায় চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করুন)

Post a Comment

أحدث أقدم